এ
সম্বন্ধে ‘বিবর্তন/জন্মান্তরবাদ’ প্রতিবেদনটিই যথার্থ। তবুও কোরানে বর্ণিত
আদম থেকেই মনুষ্য সৃষ্টির জটিল ধারণাটি সংস্কারের জন্য প্রায় একই বিষয়
ভিন্নভাবে পুনঃআলোচনা করতে হলো।
সৃষ্টির
সৃষ্টি সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা ক্ষণজন্মা মানুষের পক্ষে সম্ভব
নয়। তাছাড়া স্থুল, সূক্ষ্ম ও জ্যোতি, একই দেহে এই তিন দেহের সমন্বয়
(থ্রী-ডায়মেনশন) সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান না থাকলে (দ্র: ধর্ম দর্শন) এটা
বোধগম্য হওয়া কঠিন বটে! বিজ্ঞানীগণ যখন ইচ্ছা, আকর্ষণ ও জ্ঞানের মৌল
আবিষ্কার করতে পারবেন ঠিক তখনই বিষয়টি সহজবোধ্য হবে; তবে তা বহু দূর।
মানুষ
সৃষ্টি সম্বন্ধে কোরানে বহুবার এবং বহুভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে বর্ণিত হয়েছে,
যেমন : ক. মাটি দিয়ে খ. আঠালো মাটি দিয়ে গ. ঠন্ ঠনে মাটি দিয়ে ঘ. ঝংকার
যুক্ত কাদা মাটি দিয়ে ঙ. মথিত মাটির সার অংশ দিয়ে চ. সংমিশ্রিত তরল পদার্থ
দিয়ে ছ. তরল পদার্থের নির্যাস দিয়ে জ. রক্ত দিয়ে ঝ. শুক্র দিয়ে ইত্যাদি।
উল্লিখিত
যে কোনো একটি সূত্র ধরে আগে বা পিছে এগোলে নির্দিষ্ট একক কেন্দ্রে নিয়ে
যাবে। যেমন ‘মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন’ তার অর্থ এই নয় যে, কুমারের মতো মাটি
মথিত করে, পুতুল তৈরি করে ৮০ কোটি (হুব্বা) বছর রোদে বা আগুনে পুড়ে অতঃপর
তার মধ্যে ফুঁক দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করেছেন।
মূলত
উল্লিখিত ধারাগুলো সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনের প্রাথমিক সূত্র মাত্র; তার যে
কোনো একটি সূত্র ধরে বিজ্ঞানীগণ (আল্লামাগণ) যাতে সৃষ্টির মূল
যুক্তি/প্রমাণে পৌঁছতে পারে।
যেমন :
‘মাটি দিয়ে সৃষ্টি!’ প্রশ্ন জাগে যে, মাটি কিসের সৃষ্টি! সাধারণ উত্তর:
পানির সৃষ্টি; পানি কিসের সৃষ্টি! বাতাসের সৃষ্টি। বাতাসের রয়েছে অসংখ্য
উপাদান। সেগুলো ভাজন-বিভাজন করতে করতে বৈজ্ঞানিকগণ (আল্লামা) এ্যাটম,
নিউট্রন, প্রোটন ও ইলেকট্রনে পৌছে ভাবলেন যে, বস্তু বিভাজনের এটাই শেষ একক।
কিন্তু পরে দেখলেন যে না, তারও বিভাজন সম্ভব; শুধু তাই-ই নয়, এই বিভাজনের
আর শেষ নেই। যতই বিভাজন করতে সক্ষম হচ্ছেন ততই শক্তি, মহাশক্তি মানুষের
অধীন হচ্ছে, অদৃশ্য দৃশ্যতর হচ্ছে। স্মরণীয় যে, এটা বস্তু সৃষ্টির
সূত্ররহস্য মাত্র, জীবন সৃষ্টি নয়। আর ডারউইন বস্তদেহ ব্যতীত জীবন সৃষ্টির
বিবর্তন সম্বন্ধে কিছুই বলেননি।
যে কোনো
জীবদেহ বা বস্তুর বিভাজন করতে করতে যেমন নিউট্রন প্রোটন ইলেকট্রনে পৌঁছা
যায়, ঠিক তেমনি একক পরমাণু যোগ করতে করতে যে কোনো বস্তু বা জীবদেহ তৈরি বা
হওয়া যুক্তিসঙ্গত। অতএব এক্ষণে আপাতত বলা যায় যে, মানুষ এবং যাবতীয়
জীব-জন্তু বা বস্তু এবং গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি এ্যাটম, নিউট্রন, প্রোটন ও
ইলেকট্রন থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আর অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীগণ যখন আমিত্ব,
আকর্ষণ, ইচ্ছা ও জ্ঞানের একক আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন তখনই জীবন-মৃত্যু,
স্রষ্টা-সৃষ্টির রহস্য-জটলা বহুলাংশে খুলে যাবে সত্য, কিন্তু ততোধিক নতুন
জটাজালে আবদ্ধ হবে। এ সময় রকেট, প্লেন, লোহা-লক্কর, যন্ত্রপাতির ব্যবহার
হ্রাস পেয়ে বিজ্ঞানীগণ আকাশ-পাতালের অধিকাংশ দুর্ভেদ্য ও অকল্পনীয়
আবিষ্কারে স্বয়ং নিজের দেহ এবং কথাই হবে স্বয়ংক্রিয় এবং সর্বস্ব।
পক্ষান্তরে আল্লাহ্ উপলব্ধি, আল্লাহঙ্কার আজকের মতোই নিখুঁত ও অম্লান
থাকবে। পূর্বেও বর্ণিত হয়েছে যে, যাবতীয় সৃষ্টির নিকটতম ২টি ভাগ ও উপাদান ৪
+ ৪ = ৮টি:
বস্তুর উপাদান: আগুন, বাতাস, পানি ও মাটি।
জীবনের উপাদান: আমিত্ব (স্বত্তানুভুতি), আকর্ষণ (প্রেম), ইচ্ছা ও জ্ঞান।
মৃত্যুতে যার যার স্থানে সে ফিরে যায়, মিশে যায় বা একত্রিত হয় (তথ্য: ২: ২৮, ১৫৬; ৩: ২৮, ৪৫; ৬: ৩৬; ৮৬: ৮; ৯৬: ৮; অসংখ্য]
ছোটবেলার
ভূগোলে পাওয়া যেত যে, বিজ্ঞানীদের মতে বস্তু হিসেবে পৃথিবীতে একটি মানুষ
চাঁদের তুলনায় একটি পিপঁড়ার ১ শত ৬০ ভাগের এক ভাগ; অতএব পৃথিবীর তুলনায়
পিপঁড়াটির ৮ শত ভাগের এক ভাগ; সূর্যের তুলনায় ৭২ কোটি ভাগের এক ভাগ
(সম্ভবত)। যা দেখতে মহা শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপেও সম্ভব কিনা সন্দেহ! অতএব
গ্যালাক্সি পর গ্যালাক্সি বা বিশ্ব-মহাবিশ্বের তুলনায় মানুষ তো দূরের কথা
এমনকি পৃথিবীর বস্তুত্ব প্রমাণ করা খুব সহজ নয়। অর্থাৎ মানুষ বস্তু বলতে
কোনো বস্তুই নয়। আমরা অদৃশ্য, আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। মানুষ নিউট্রন
প্রোটন ইত্যাদির চেয়েও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পর-পর-পর-মাণু বলেই তার চেয়ে বড়
বস্তু অণু-পরমাণুদি মানুষের চোখে দৃষ্ট হয়, আবিস্কার করতে সক্ষম হয়। তবুও
আমাদের আকৃতি-প্রকৃতি, সাধারণ দর্শন ও স্বাভাবিক পরিমাপ করি একমাত্র দেহ
খণ্ডিত জীবন বা সীমাবদ্ধ জীবনের কারণে (ধর্ম দর্শন লক্ষণীয়)।
মানব সৃষ্টির সূচনা আদম থেকেই নয়:
অইজ
ক্বা-লা...তা’লামুন। [২: বাকারা-৩০] অর্থ: স্মরণ কর: যখন রব ফেরেস্তাদেরকে
বললেন, ‘আমি বস্তুর (আর্দ্ব অর্থ: বস্তু বা দৃশ্য, পৃথিবী নয়; ‘পৃথিবীর
আরবি শব্দ ‘দুনিয়া)’ প্রতিনিধি নিয়োগ করি/করবো।‘ তারা বলে/বললো, ‘আপনি কি
সেখানে এমন কাকে সৃষ্টি করেন/করবেন! যারা অশান্তি ও রক্তপাত করে/করবে?
আমরাই তো আপনার স্তুতিবাদ ও পবিত্রতা গান গাই।‘ তিনি বলেন, ‘আমি যা জানি
তোমরা তা জান না।‘
প্রকাশ
থাকে যে, আল্লার শক্তি ও জ্ঞানের বাইরে মানুষ, জ্বীন, ফেরেস্তা কারো এমনকি
কল্পনা করারও ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ মানুষ চোখ বন্ধ করে যদি কল্পনা করে যে,
একটি মানুষের ১০টি মাথা; একটি মানুষ হাত বাড়িয়ে চন্দ্র বা সূর্যকে স্পর্শ
করছে; টিভিতে নিয়মিত প্রদর্শিত কার্টুন ছবি, ‘ভয়েজার’-এর দৃশ্য ও ঘটনাগুলো
কল্পনাপ্রসূত; এই যাবতীয় কল্পনা সৃষ্টিগুলো আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে আছে বলেই
মানুষ তা কল্পনায় সৃষ্টি বা নকল করতে পারে। অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে যা নেই
তা মানুষ-জ্বীন, ফেরেস্তা কল্পনায়ও সৃষ্টি করতে পারে না। অতএব, ফেরেস্তাগণ
যখন বললো যে, ‘এমন প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন/করবেন, যারা সেখানে অশান্তি ও
খুনাখুনি করে/করবে।’ এর অর্থই এমন এক জাতি সম্মন্ধে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা
আছে (জিন, জান্, খাড়া মানুষ বা অন্য কোনো জীবই হোক) যারা আমাদের মতোই
হাগু/পিপি করা রক্ত মাংসের দেহধারী জীব ছিল এবং তারা আজকের মতো দুনিয়ায়
অশান্তি, খুনাখুনি বা রক্তারক্তি করতো!
মূলত
উল্লিখিত আদম সৃষ্টিরহস্য সূত্রটি প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রেই সমভাবে
প্রযোজ্য; ঐ সূত্রটি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট নয়। ‘আমাকে’
সৃষ্টি করে অতঃপর ‘আমার দেহ’ সৃষ্টি করা হয়; আর তাই বলেই আমার হাত, আমার
মাথা, আমার দেহ, আমার লাশ, আমার কবর, সবকিছুই আমার দাবি করি কিন্তু ‘আমি’
কই! ‘আমি’ কে এবং কী! ‘আমি’ অদৃশ্য অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত কথায় ‘দেহদ্বারা
খণ্ডিত জীবন’; ‘আমার’ দৃশ্য অর্থাৎ দেহ। অদৃশ্য ‘আমি’কে সৃষ্টি করার পরে
আমার দেহ সৃষ্টি করে; অতঃপর আমাকে (আমি + আমার) কোন এক গ্রাম-গঞ্জে নিক্ষেপ
করা হয় (জন্ম হয়) এবং আমার স্ত্রীকে নিক্ষেপ করা হয় অজানা অন্যত্র। ধীরে
ধীরে যতই বড় হতে লাগলাম ততই স্ত্রীর আকাংক্ষা তীব্রতর হতে লাগল; দীর্ঘ দিন
যাবত খোঁজাখুঁজি, কান্নাকাটির পরে কোন এক গ্রাম/শহরে স্ত্রীর সন্ধান পেলাম,
মিলন হলো।
উল্লিখিত
আদমের ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যেকটি মানুষের জন্মেরই ইঙ্গিত। কোরানও তাই
ঘোষণা করে: অ লাক্বাদ...মিনাচ্ছা-জ্বিদীন। [৭: আরাফ-১১] অর্থ: আমি
তোমাদিগকে সৃষ্টি করি অতঃপর তোমাদের দেহ সৃষ্টি করি; অতঃপর ফেরেস্তাগণকে
(পজেটিভ/ধ্বণাত্মক শক্তি) মানুষের অনুগত থাকতে বলি। তবে ইবলিছগণ (নিগেটিভ/
ঋণাত্মক শক্তি) ব্যতীত অন্য সকলেই অনুগত থাকে; যে অনুগত থাকে সে ইবলিছের
(ঋনাত্মক) দলভুক্ত নয়।
আদম
জন্মের আর একটি সূত্র কোরানে আরো সহজ করে বলেছে, “ইন্না মাছালা...মিন
তুরাব”। [৩: এমরান-৫৯] অর্থ: নিশ্চয়ই ঈছার জন্ম দৃষ্টান্ত আদমের মতোই; তাকে
মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব ঈছার জন্ম সরাসরি মাটি থেকে পুতুল তৈরির
মতো যে নয় এবং কিভাবে! তা কোরানে সহজ সরলভাবে বর্ণিত আছে:
“অজ
কুর...ক্বাছিয়া”। [১৯: মরিয়ম- ১৬-২২] অর্থ: শ্রবণ করো! এই কিতাবে উল্লিখিত
মরিয়মের কথা, যখন সে তার পরিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে নির্জন ...কোঠায় আশ্রয়
নিলো; অতঃপর লোকজন থেকে নিজকে আড়াল করার জন্য পর্দা করলো। অতঃপর আমি তার
নিকট ফেরেস্তা পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত পুরুষ রূপেই হাজির
হলো। মরিয়ম বললো, ‘তুমি যদি আল্লাহকে ভয় করো তবে আমি তোমার অশ্লীল উদ্দেশ্য
থেকে রক্ষার জন্য আল্লার সাহায্য চাই। সে বললো, ‘আমি তো আল্লাহর প্রেরিত,
তোমাকে একটি পুত্র দেয়ার জন্য এসেছি। মরিয়ম বললো, ‘কেমন করে আমার পুত্র
হবে! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি চরিত্রহীনাও নই?’ সে বললো,
‘এভাবেই হবে।’ আল্লাহ বলেছেন, ‘এটা আমার জন্য বৈধ (সহজ) এবং আমি একে এই
জন্য সৃষ্টি করবো যেন সে মানুষের জন্য আমার অনুগ্রহের এক নিদর্শন হয়; এটা
পূর্ব পরিকল্পিত বিষয়; তখন সে তা তার গর্ভে নিলো। অতঃপর সে গর্ভাবস্থায় লোক
লজ্জায় দূরে আত্মগোপন করলো...।
উল্লিখিত
আয়াতের মোটা অক্ষরের বাক্যসহ পূর্ণ আয়াতটি গবেষণা করলে যে চিত্র
স্বাভাবিকভাবে উদয় হয় তার অর্থই ‘এইভাবে,’ অর্থাৎ চিরাচরিত প্রকৃতির নিয়ম
অনুসারেই। সহজবোধ্যের জন্য আয়াতে পরিষ্কার করে বলেই দেয়া হয়েছে যে,
‘ফেরেস্তাটি পুরুষই নয় বরং পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত পুরুষ ছিল। ‘ফেরেস্তা’ ‘রূহ’
‘মালাকুত’, পার্শি ও আরবি শব্দের বঙ্গানুবাদ।
কি! তার
চরিত্র ও স্বরূপই-বা কী! ইত্যাদি জ্ঞানপ্রাপ্ত হলে সঠিক তত্ত্ব উদ্ঘাটন
সম্ভব হবে। তাদের কামভাব আছে, তা যখন প্রমাণিত তখন মানুষের অধিকাংশ স্বভাব
থাকাই যুক্তিসঙ্গত বটে! আর একথাও স্মরণীয় যে, ফেরেস্তার চেয়েও মানুষ
শ্রেষ্ঠ। ফেরেস্তাগণ মানুষের দাস। [৭: আরাফ-১১] পক্ষান্তরে মরিয়মের ঐ ঘটনায়
তৎকালীন মৌলবাদীগণ ফেরেস্তাদের গুরু মানুষ, শুধু মানুষই নন! আল্লাহর নবী
জাকারীয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে (মূলত তিনি দোষী নন) ; কথিত হয় তিনি প্রাণভয়ে
গাছের সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করেন; কিন্তু তারা খোঁজ পেয়ে করাত দিয়ে গাছটি দুই
টুকরা করে জাকারীয়ার দেহ দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে! পান্থার নামক কোনো এক
ব্যক্তিকেও তারা সন্দেহ করতো। অথচ মানুষের গোলাম ‘ফেরেস্তার’ কথা উল্লেখ
করায় কারো কোনো ঘৃণা বা আপত্তির উদ্রেক হয়নি! ঈছার জন্ম তথ্যের মধ্যেই
আদমের সৃষ্টিতত্ত্ব উদ্ধারের ইঙ্গিত দিয়েছে উল্লিখিত এমরানের ৫৯ নং আয়াতে।
মূলত আদম সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা, ধারণাই মাত্র; যার পক্ষে কোনো
বৈজ্ঞানিক বা আধ্যাত্মিক যুক্তি ও সাক্ষী-প্রমাণ জোগাড় করা কঠিন।
সৃষ্টিতত্ত্ব
সম্বন্ধে কোরানে অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর প্রত্যেকটি
সূত্রের মূল বিষয়বস্তু ‘বিবর্তনবাদ;’ একে প্রচলিত শরিয়ত তত্ত্বে মায়ের
পেটের পর্যায়ক্রমবাদ বলে সীমাবদ্ধ করেছে। এর বাইরে ভাবতে নারাজ, তার কারণ:
হাদিছে লেখা ‘আল্লাহ কুমারের মতো আজরাঈল কর্তৃক মাটি সংগ্রহ করে পুতুল করে
ফুক দিয়ে আদম সৃষ্টির বিশ্বাস মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে!
মায়ের
পেটে মাত্র ৮/১০ মাসের ‘পর্যায়ক্রম’ আদিকাল থেকে বিশ্বের একটি মানুষও
অস্বীকার করেনি বা অজানা কোনো বিষয় নয়; উপরন্তু এই সাময়িক পর্যায়ক্রমটি
বিভিন্ন আয়াতে পূর্ণ ব্যাখ্যাসহ বর্ণিত আছে। তাদের ভাবা উচিত যে, ঐ রক্ত,
বীর্য ইত্যাদিরও আগে/পিছে জটিল ও বহুমুখী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ক্রম
রয়েছে! ‘পর্যায়ক্রম’-এর সহজ-সরল ভাষাই ‘বিবর্তন বা জন্মান্তরবাদ।’
বিবর্তনবাদ যে কোনোভাবেই গবেষণা করলে মহাজ্ঞানী (আল্লামা) চার্লস ডারউইনের
‘ইভলিউশন থিওরী’ সম্পূর্ণ কোরানভিত্তিক যা ‘ বিবর্তনবাদ’ অধ্যায় সুত্রসহ
আলোচিত হয়েছে।
মূলত
ডারউইন উল্লিখিত কোরানের আয়াতেরই সঠিক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র।
হয়তো-বা তিনি জীবনে কখনও কোরান বা ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়েও দেখেননি। কিন্তু রাছুল
যেখান থেকে কোরান এনেছেন ঠিক সেখান থেকেই তিনি ‘বিবর্তনের সূত্র ও
ব্যাখ্যা এনেছেন।
পুনর্বার লক্ষণীয়
মানুষ
জীব-জন্তু, পশু-পক্ষির (উদ্ভিদ) মতোই একটি উম্মত (৬: আনআম-৩৮) খ. সবকিছুই
মাটি থেকে সৃষ্টি (১১: ৬১; ১৮: ৩৭; ২২: ৫, ৬) গ. সকল জীব-জন্তু পানি থেকে
সৃষ্টি (২৪: নূর-৪৫) ঘ. একটি মাত্র জীবন কোষ থেকে সৃষ্টি (৬: আনআম- ৯৮)।
অর্থাৎ
শুধুমাত্র বানরই নয়! কুকুর, শুকরসহ সকল গেজা (যা গজায়/উদ্ভিদ), বয়েজা (ডিম
থেকে জন্ম) অয়েজা (ডিম-বিহীন জন্ম), সবকিছুই সৃষ্টির উপাদান এক এবং একক
জীবনকোষ এবং আবর্তন বিবর্তন চক্রে মানুষ তাদেরই জ্ঞাতি-গোষ্ঠির পরিশোধিত/
বিবর্তিত জাতি; এটাই বর্ণিত কোরান সমর্থিত চিরসত্য ‘ইভলিউসন থিওরি অব
ডারউইন।’
জীবের
দৈহিক বিবর্তন, পরিবর্তন কিভাবে হয়! এক জাত থেকে অন্য জাতে যেতে কত হাজার
বা কোটি বছর লাগে তা ক্ষণজন্মা মানুষের ইতিহাস বা স্মৃতির নাগালের বাইরে
বলেই তা বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। এটা দুধ থেকে ঘি, মাটি থেকে কলসি বা সোনা,
হীরা-পাথর হওয়ার মতো সময়কাল নয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ‘কালের
বিবর্তন চক্রে মানুষের এমন একটি অবস্থানকাল ছিল, যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু
ছিল না [৭৬: দাহর-১]।
অর্থাৎ
স্থান ও কালের সংঘর্ষে জীবনের আবর্তন-বিবর্তন (জন্মান্তরবাদ) চক্রে মনুষ্য
দেহের আজ উল্লেখযোগ্য অবস্থান। অর্থাৎ হঠাৎ করে বা দৈবক্রমে মানুষের
বর্তমান অবস্থা হয়নি। তবে কখন থেকে মনুষ্যদেহের সূচনা অতঃপর বর্তমান অবস্থা
ধারণ করেছে তা ক্ষণজন্মা মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়; তার অন্যতম প্রধান
কারণ সৃষ্টির শুরু-শেষহীন বিবর্তন চক্র।
সৃষ্টি
গতিশীল, আবর্তন-বিবর্তনশীল প্রক্রিয়ায় মনুষ্যদেহ ধারণই শেষ ধাপ। এই চক্রে
পৌঁছতে ৫/৭ হাজার বৎসর পূর্বে পবিত্র বেদ বলছে, ‘৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে
মনুষ্য জন্ম লাভ করে।’
জ্ঞানের বিবর্তন স্বীকার করলে, বস্তুর বিবর্তন অনিবার্য! চোখের সামনে যাবতীয় বস্তুই তার জলন্ত সাক্ষী।
শুধু
মানুষই নয় সমস্ত জীব-জন্তু, গাছপালা, হীরা-জহরত, সোনা, মণি-মাণিক্য, গ্যাস,
বিষ, ইউরেনিয়াম, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির প্রধান উপাদান একই।
‘আমি’
বলতে জীবন, ‘আমার’ বলতে দেহ বা বস্তু। ‘আমি’ অদৃশ্য, ‘আমার’ দৃশ্য। দেহ বা
বস্তুর সৃষ্টি সূত্র যেখানে শেষ; ‘জীবনের জন্মসূত্র সেখান থেকেই শুরু বলা
যায়। জীবনের প্রধান উপাদান: আমিত্ব, মহব্বত, এরেদা ও এলেম; অর্থাৎ
সত্তানুভূতি, আকর্ষণ, ইচ্ছা ও জ্ঞান। এগুলোর মূলত ‘আল্লাহ’ শব্দের মতোই
পরিবর্তন, বিবর্তন, বচন বা লিঙ্গান্তর হয় না; তবে প্রত্যেকটি একক চক্রাকারে
ঘুরে ফিরে আবর্তিত হয়ে ৩ টি মিলে ৪র্থটির জন্ম দেয় (দ্র: ‘আল্লাহর
পরিচয়’)।
আপেক্ষিক
বিশ্বাস/অবিশ্বাস ব্যতীত সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটন মানুষের পক্ষে কোনো দিনও
সম্ভব হবে না; যেমন সম্ভব হয় না আপন দেহের বিভিন্ন গ্রহ/গ্যালাক্সিতে
বসবাসরত একটি কীটের পক্ষে পূর্ণ মানুষটিকে আবিষ্কার করা।
সম্প্রতি
ইন্টারনেটে পাওয়া এবং বাংলাদেশের কোনো এক দৈনিকে তা প্রকাশ যে, বিজ্ঞানীগণ
প্রকৃতি সৃষ্টির সূচনা বা সময়কাল সম্বন্ধে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন
যে, প্রকৃতি সৃষ্টিতে ঘড়ির ১ সেকেন্ডের ১ ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ সময়ও
লাগেনি। এর অর্থই সৃষ্টির আবর্তন-বিবর্তনের খ-িত কালের অভিজ্ঞতা ব্যতীত এর
শুরুও নেই, শেষও নেই অথবা ঐ সিদ্ধান্তে পৌঁছা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রেরণাপ্রাপ্ত
মুজিবুল হক বলেন যে, ‘মানুষের এমন একদিন আসবে, যেদিন মরা-জেতা একই সঙ্গে
মিলে-মিশে বসবাস করবে, জন্ম-মৃত্যুও একই সঙ্গে চলবে।’ তখনই জীব বা
মনুষ্যজন্মের বিবর্তিত সূত্র আবিষ্কার হবে এবং তা বিজ্ঞানীদের দ্বারাই
সর্বজনবিদিত হবে।
No comments:
Post a Comment